একটি 'ছ্যাপাক্রান্ত' জাতির করোনা-ভাগ্য

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

মাত্রই বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। লক্ষ্য সদাই করা। গেট থেকে বের হওয়ার ঠিক দুই মিনিটের মাথায় আক্রমণ। একজনের মুখ নিঃসৃত লালা ঠিক আমার পায়ের এক হাত সামনে নিক্ষিপ্ত হলো। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে থমকে গেলাম। এমন অভিজ্ঞতা তো অনেক দিনের, তাই নিজের পা নিয়ন্ত্রণের বিদ্যাটা রপ্ত হয়েছে। এ ছাড়া আর উপায়ই বা কী?

মুখ নিঃসৃত লালার কিছু প্রচলিত বাংলা নাম আছে। প্রকারান্তরে থুতু, কফ ইত্যাদি ইত্যাদি। আঞ্চলিক বাংলায় বলা হয় ‘ছ্যাপ’। বাসা থেকে বের হওয়ার পরের ১৫ মিনিট রাস্তায় ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি একটি সুনির্দিষ্ট বিষয় পর্যবেক্ষণের বিষয়ে ভাবলাম। পর্যবেক্ষণ শেষে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে আমরা একটি ‘ছ্যাপাক্রান্ত’ জাতি। ছ্যাপ ও আক্রান্ত—এই দুটি শব্দের মধ্যে অযাচিত সন্ধি স্থাপন করার বিষয়টি ব্যাকরণবিদেরা দয়া করে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। প্রচণ্ড ক্ষোভ ও অসহায়ত্বের ঘুঁটা থেকে এই শব্দের উদ্ভব। তখন কি আর ব্যাকরণের নিয়মকানুন খেয়াল থাকে?

বাসা থেকে বের হওয়ার পর প্রায় ২০০ মিটার হেঁটে আমাকে দোকানে যেতে হয়েছিল। এইটুকু দূরত্বের মধ্যেই অন্তত ১০ জনকে পেলাম ‘ছ্যাপাক্রান্ত’ হিসেবে। তাঁরা আপনমনে রাস্তার আনাচকানাচ ভিজিয়ে চলেছেন। সেই ভেজানোতে কোনো ‘কিন্তু কিন্তু’ ভাব নেই। কেউ রাস্তার কোনায় মুখ নিচ্ছিলেন, কেউ মুখ একটু আড়াল করে ধরণির বুককে সিক্ত করছিলেন। আবার কেউ কেউ কোনো কিছুরই ধার ধারছিলেন না। পথচারী আছে কি নেই, কারও গায়ে পড়ছে কি পড়ছে না—সেসব না ভেবেই বিকট শব্দে ছ্যাপ ছুড়ছিলেন তাঁরা। ঠিক যেমনটা রকেট ছোড়ার আগে ইগনিশন হয়। তবে রকেট অবশ্য জনবহুল জায়গা থেকে ছোড়া হয় না। তার জন্য সংগত কারণেই বেছে নেওয়া হয় জনবিরল স্থান।

এই ঢাকা শহরে মানুষের সংখ্যা ঢের বেশি। মোট সংখ্যার হিসাবে গুটিকতক মানুষেরই চলার পথে নিজের গাড়ি ব্যবহারের সচ্ছলতা আছে। অন্যরা কেউ গণপরিবহন ব্যবহার করেন, কেউ রিকশা। ঠিক হাঁটাদূরত্ব না হলেও অনেকে গন্তব্যে যেতে দুই পায়ের ওপর ভরসা করেন। বাংলা সিনেমার ভাষায় এরা গরিব হলেও ছোটলোক নন, তাই বিত্তের অভাবহেতু অর্থ সঞ্চয়ের প্রবৃত্তিতে আক্রান্ত হন। আমিও এই শ্রেণির। হাঁটাপথে আমারও কিছু টাকা বাঁচে। কিন্তু চারদিক থেকে ধেয়ে আসা জলকনায় খুব অস্বস্তিতে আছি।

এমন এক শহরেই এখন করোনা–আতঙ্ক বিরাজমান। লক্ষণ দেখা দিলেই সরকারি দপ্তর মানুষকে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনে নিচ্ছে। এ কাজটি সরকার মূলত করছে রোগের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, করোনা একধরনের সংক্রামক ভাইরাস। পৃথিবীর শতাধিক দেশে এর সংক্রমণ দেখা গেছে। করোনাভাইরাস ছড়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে, আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ভালোভাবে সাবান–পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে, হাত না ধুয়ে চোখ, মুখ ও নাক স্পর্শ করা যাবে না, হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় মুখ ঢেকে রাখতে হবে ইত্যাদি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো সর্দি-কাশি, জ্বর বা অসুস্থ ব্যক্তির কাছ থেকে অন্তত এক মিটার বা তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কারণ আর সব ফ্লুর মতোই এই রোগও কাশির ক্ষুদ্র ড্রপলেট বা কণার মাধ্যমে অন্যকে সংক্রমিত করে। তাই যিনি কাশছেন, তাঁর থেকে দূরে থাকতে হবে। কিন্তু স্থানকাল–নির্বিশেষে রাস্তাঘাটে থুতু ফেলা এই শহরের মানুষেরা কীভাবে এই কাশি–শিষ্টাচার বা ড্রপলেট ছড়ানো কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের দূরে রাখবে? অন্তত আমি তার প্রমাণ পাইনি।

তবে হ্যাঁ, হ্যান্ডওয়াশ-স্যানিটাইজার ও মাস্ক কেনার বিষয়ে আমরা অত্যন্ত সচেতন। এতটাই যে গত রোববারের হুড়োহুড়িতে অংশগ্রহণ না করার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে আজও পরিচিত দোকানটিতে গিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার পেলাম না। দোকানি জানালেন, কবে আসবে জানানো কঠিন! হ্যান্ডওয়াশও পাওয়া গেল না ওই দোকানে, শেষ হয়ে গেছে। ওদিকে মাস্কের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। যদিও জনৈক মাস্ক বিক্রেতা পানের পিক রাস্তায় বিসর্জন দিতে দিতে আমার মনে স্বস্তি আনার চেষ্টা করলেন। জানালেন, এক দিন আগে দাম আরও বেশি ছিল।

সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে—আতঙ্ক ছড়ানোর বিষয়ে আমরা মাত্রাতিরিক্ত সচেতন হলেও, স্বাস্থ্য নিয়ে কিঞ্চিৎ পরিমাণও নই। আজ একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন এভাবে থুতু ফেলছেন? তবে তিনি যে অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন, মনে হলো প্রশ্নটি তুলে আমি মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট কোনো বিরাট সংকট সৃষ্টি করে ফেলেছি! উত্তরও দেননি স্বভাবতই। তাঁর সেই আচরণে নিজের রাস্তা মাপার ইঙ্গিত পেলাম আমি।

বর্তমান পরিস্থিতিতে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাশির আদবকেতা বা রেসপিরেটরি হাইজিন মেনে চলতে। কাশি বা হাঁচি দেওয়ার সময় নাক, মুখ রুমাল বা টিস্যু বা কনুই দিয়ে ঢেকে রাখতে বলছেন। পরামর্শ দিচ্ছেন ব্যবহৃত টিস্যু ঠিক জায়গায় ফেলতে। কিন্তু যে শহরের মানুষেরা কফ-থুতুই ঠিক জায়গায় ফেলে না, তারা কি ব্যবহৃত টিস্যু নিয়ে আদৌ ভাববে?

বড় বিষয় হলো, নিজেদের খাসলতে পরিবর্তন আনা জরুরি। বাংলা অভিধান বলছে, খাসলত শব্দের অর্থ স্বভাব বা আচরণ বা অভ্যাসাদি। আসুন, নিজেদের ক্ষতিকর অভ্যাস বদলে ফেলি। পুরো শহরটাকে বেসিন না বানাই। শুরুতে বদল মেনে নেওয়া কঠিন বোধ হয়। কিন্তু প্রশ্ন যখন প্রাণ বাঁচানোর, তখন অভ্যাস বদল যত দ্রুত হয়, ততই মঙ্গল।

এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব-কর্তব্যের প্রতি অনেকেই আঙুল তুলতে পারেন। এটি ঠিক যে জনসাধারণকে এসব ব্যাপারে সচেতন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে সরকারকে। কিন্তু সব কাজের ভার শুধু সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নির্ভার থাকলে তো হবে না। নাগরিক হিসেবে আমাদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। সরকার যতই চেষ্টা করুক, নিজেদের স্বভাব পরিবর্তনের মূল চাবিকাঠি কিন্তু আমাদের হাতেই।

অর্ণব সান্যাল: লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]